আমাদের বাড়ির পুজোয় সিদ্ধির কচুরি এক্কেবারে এক্সক্লুসিভ: ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়
যুগাবতার লোকনাথ তিনি, এখন কাজ করছেন ‘প্রথমা কাদম্বিনী’-তে ডঃ রাজেন্দ্র চন্দ্র চন্দ্রর ভূমিকায়। ছোটপর্দা ও বড়পর্দার জনপ্রিয় মুখ ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কাছে পুজো সবসময় স্পেশ্যাল। কারণ তাঁর নিজের বাড়িতেই দুর্গাপুজো হয় বাঁকুড়ার চকবাজারে। এবার ভাস্বরদের বাড়ির পুজো আশি বছরে পদার্পণ করছে। কিন্তু মহামারীর কারণে এবারের পুজোয় যেতে পারবেন কিনা বুঝতে পারছেন না ভাস্বর। তাঁর পুজোর গল্প শুনলেন শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাঁকুড়া নয়, বেনারস
প্রথমেই একটা কথা বলি, অনেকেই ভাবেন আমি বাঁকুড়ার ছেলে। যেটা আদতেই ভুল। বাঁকুড়ার আদি বাড়ি আমার ঠাকুমার বাড়ি। ঠাকুমার যেহেতু কোনও ভাই ছিল না, তাই উনি এসব সম্পত্তি পেয়েছিলেন তাঁর পিতৃপুরুষের থেকে। ঠাকুমার বাড়িতেই আমাদের পুজো আশি বছর আগে শুরু হয়। আমার বাবার বাড়িও বাঁকুড়া নয়। আমার ঠার্কুদা বা বাবারা বেনারসের লোক। আমি কলকাতায় জন্মেছি,কলকাতায় বড় হয়েছি।
কিন্তু এই পুজোটা ঘিরেই আমাদের সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা হওয়ার সময়। সেটা এবার ভীষণ মিস করব না যেতে পারলে। বুঝতেই পারছি না এবার পুজোটা কী ভাবে কী করব আমরা। আমার কাকা কাকিমা বাঁকুড়াতেই থাকেন। কিন্তু আমার সবচেয়ে বেশি চিন্তা হচ্ছে এবার কাজ উদ্ধার হবে কীভাবে? লোকে বলে ছোট করে পুজো করব কিন্তু ছোট করে দুর্গা পুজো হয় না। অনেক রকম ব্যাপার আছে। ঢাকী আনা উচিত হবে কিনা জানি না। পুজোয় কাজের লোকেরাও বাইরে থেকে আসেন তো।
বাড়ির পুজো জীবনের অংশ
এ বছর করোনা পরিস্থিতি না হলে অনেক বড় করে হত পুজো। সবাই মুখিয়ে থাকে এই পুজোর সময়টার জন্য। ওঁদের সবার মন খারাপ করছে। আমাদের কাছে পুজোটা জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছে। বছরে একবার মায়ের মুখটা না দেখলে ভাল লাগে না। জন্ম থেকে এখনও অবধি প্রত্যেক বার যাই। এবার কী হবে জানি না। আমার যাওয়া তো শুধু একার নয়। বাবার তো বয়স হয়েছে। গাড়ি করে আমি আর বাবা চলে যেতেই পারি, কিন্তু বাবার জন্য সেটা নিরাপদ হবে না। পুজোর সময় সেভাবে বিধিনিষেধ তো মানা হয় না। আর পুজোর সময় যারা ঠাকুর দেখতে আসেন তাঁদের কী বলতে পারা যায়, ঢুকবেন না, বেরিয়ে যান।
আমি যে কমপ্লেক্সে থাকি সেখানেও পুজো হয়। ওঁরা বলছেন পুষ্পাঞ্জলি হবে না, শুধু হাত জোড় করে অঞ্জলি হবে। বাড়ির পুজো আলাদা জিনিস।
সিদ্ধির পুরভরা কচুরি
আমাদের অষ্টধাতুর প্রতিমা। আমাদের বৈষ্ণব মতে পুজো হয়। কোনও বলি হয় না। এমনকি আখ, চালকুমড়ো বলিও হয়না।
তবে চার দিন চার রকমের ভোগ খাবার দাবার হয়। সব নিরামিষ হয় আমাদের পুজোয়। সপ্তমীর দিন সাদা ভাত, ডাল, পাঁচ রকমের ভাজা, তরকারি, চাটনি, পায়েস, মিষ্টি। অষ্টমীর দিন তো খিচুড়ি অবশ্যই। সঙ্গে সাত রকমের ভাজা, ধোকার ডালনা এসব হয়। নবমীর দিন হয় পোলাও, সঙ্গে তরকারি, পায়েস, চাটনি। দশমীর দিন আমাদের যেহেতু অষ্টধাতুর প্রতিমা, তাই ঘট বিসর্জন হয়। মায়ের ঘট বিসর্জন হয়ে যাওয়ার পর আমাদের পুকুর থেকে মাছ ধরে এনে সেই মাছের ঝোল ভাত খাওয়া হয়। এটাই নিয়ম। এত বছর ধরে এটাই চলে আসছে।
আর একটু সিদ্ধি তো দিতে হয় পুজোর সময়, আমরা যেটা করি দশমীর দিন পুজো হয়ে যাওয়ার পরে আমাদের বাড়িতে সিদ্ধির কচুরি হয়। এটা খুব ইন্টারেসটিং, এটা কিন্তু কোথাও পাওয়া যায় না। আমাদের পুজোর এক্সক্লুসিভ। ময়দার ভিতরে সিদ্ধির পুর করে কচুরি তৈরি হয়। আর সেই সিদ্ধির কচুরি খেয়ে তো মানে বেশ ভাল নেশা হয়। একবার যদি কেউ হাসতে শুরু করে হাসতেই থাকে, অনেক মজার কাণ্ড হয়, ছোটদের খুব একটা দেওয়া না হলেও প্রায় সবাই খায় সিদ্ধির কচুরি। দশমীতে সবাইকে প্রণাম কোলাকুলি করে রাতে সিদ্ধির কচুরি খাওয়া মাস্ট।
মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা
পুজো কিছুই কিনিনি এবার। আমার সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে, পুজো যেহেতু এবার সব জায়গায় ছোট করে হচ্ছে, ফলে কত লোকের রুজি রোজগার মারা যাচ্ছে। গ্রাম থেকে কত লোক কলকাতায় এসে কাজ করে পয়সা পেত। সেখানে আমরা নতুন ড্রেস পরে ঘুরব? এবার কেনাকাটার কথা ভাবিনি।
পুজোয় বাঁকুড়া যেতে না পারলে সেই ঘরবন্দি। হয়তো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে একদিন দেখা হল। বাবার সঙ্গেই বাড়িতে সময় কাটাব। সেটা আমার সবথেকে প্রিয়। আমার মা চলে গেছেন কয়েক বছর আগে। মায়ের নামে আমার একটি প্রতিষ্ঠান আছে ‘অপর্ণা ফাউন্ডেশন’, যেটা দুঃস্থ মানুষদের সাহায্য করে। উমফানের সময় কিছু কিছু মানুষকে সাহায্য করেছিলাম। আমরা সারাবছর কাজ করি, শীতে গরম পোশাক দিই মূলত দুঃস্থ মানুষদের। আমি নিজেই যাই সবজায়গায় দিতে।
আমার গাড়িতেই একটা ব্যাগে সোয়েটার, চাদর রাখা থাকে সবসময়। যেখানে যখন দেখি কেউ রাস্তায় দুঃস্থ, অভাবী মানুষ, তাঁদের দিয়ে দিই। যতটুকু সাহায্য করা যায় মানুষকে। এই সময় প্রচুর মানুষের কাজ নেই বড় কষ্টে আছে সবাই। সকলকে বলব পুজো সাবধানতার সঙ্গে কাটান, নিরাপদে কাটান, সুস্থ থাকুন।