বোধন
সুমন ঘোষ
(১)
থামিয়ে রেখেছি যত তারা
আকাশে প্রবাস যত সূর্যসরোবরে
গ্রহপুঞ্জে নাম লিখি শায়িত কুন্তল
সন্ধ্যাকালে বিল্ববৃক্ষ, তাম্রপাত্র, জল
কুশ-তিল-পুষ্পকন্যা হাঁটে যে উঠোনে
দুটি চোখে ঘট দুলছে, হ্রীং ভগবতী
ইহাগচ্ছ, ইহাগচ্ছ, ইহ তিষ্ঠ ইহ তিষ্ঠ ধরা
পাপাপনোদন করি, অহর্নিশ বসাই প্রহরা
কুসুমপরিখা টানি — সিঁদুর, তিলক
সকল সংকল্প যেন পিছুটান ফেলে রেখে হাঁটে
ক্ষণিকের উপচারে আজ তার দেখা পাব দুয়ারে তাকালে
আকাশে প্রবাস যত নেমে আসে, দিকচক্রবালে…
অসীমা পায়ের ছাপ পিছু-পিছু ছায়া
কিছুটা বিশ্রামে থামে— নদীতে বাড়ায় তার মুখ
দৈবশিখা শ্বাস নেয়, কামনা পুড়িয়ে করে ছাই
অকালে এসেছ বঁধু — কোথায় বসাই!
কোথায় উপমা গড়ি সর্গে-সর্গে গড়ি সেই বেদি
হাতে যার রঙ মাখা, তার কাছে নেবে না কি পাখি?
ছত্রে-ছত্রে ভুল-ভ্রান্তি নিরুত্তরা থাকে সংশোধন
ক্যুরিয়রে ডাক আসে — বোধন, বোধন!
(২)
আবার ডাকের সাজ বনেদি বাড়িতে সাজো-সাজো
ঢালু ট্রেন মাথা নীচু করে পেরোল দখিন হাওয়া,
গ্রামগঞ্জ, অজয়ের সাঁকো
কতদিন আসা নেই, ভাষা নেই, চুপিসারে তবু কেন ডাকো?
কেন ডাকো মনঃকষ্টে বীজ বুনে-বুনে
কাচের আখরে ডাকো। যেতে গিয়ে খালি কেটে যায়
কেবল কাশের বন, সৌরকার্য, যেদিকে তাকাই—
অবনত রৌদ্রদল ষোড়শোপচারে
বসে থাকে কাঁটা মেখে, স্থলপদ্মে রাখে তবু মন
বছর বৎসরে ধায় — আমার শিরায় ঘোরে, তোমার জীবন!
(৩)
চোখ আঁকা হয়ে গেছে। সামান্য তুলির টানে নাচে কনীনিকা।
অল্পবয়েসির ভিড় আসা-যাওয়া করে সে মন্দিরে
প্যান্ডেলের বাঁশ পড়ে, নাটকের শেষ রিহার্সাল—
মুখস্থ হয়নি পার্ট, প্রম্পটার ব’লে ব’লে দেয়
অগোচরে থেকে গেছে শত বাক্যব্যয়
থেকে গেছে না-তাকানো, অশ্রুগ্রন্থি যদি পিছু ডাকে
যদি বা হোঁচট খাই, ঠান্ডা হাত চূর্ণ চুল সরাও আলগোছে
কাগজে বানাও ঢেউ ভাঙা-ভাঙা চূড়া
ঝাঁপ দেব সেই তটে? যদি তুমি কোনোদিন দু’চোখে বাঁচাও–
ধক ধক ত্রিলোচন, যদি পারো একেবারে ভস্ম করে দাও!
(৪)
সহসার আঁখি জ্বলে। অবলুপ্ত ডানার দোকানে
মৃতশস্য বিক্রি হয় রোজ
রেশনে দু’টাকা চাল, উনুনে আঁচের দাম থেমে-থেমে হাসে…
শরতে আগুন লাগে। কাজলের গায়ে-গায়ে সে-তোমায় আজও ভালোবাসে!
সে-কথা বোঝো না তুমি। টান দাও সমস্ত সুতোয়
শাড়িতে যে ফাঁস লাগে কাকভোরে দূরপাল্লা ট্রেন!
কেবল যাবার আগে দেখে গেছ ক্ষুধামগ্ন খড়ের প্রতিমা
আঙুল বন্ধক রেখে, মন্ত্র কেনে, ছড়ায় মহিমা
(৫)
প্রতিমা কাগজে ছাপা বহুদূর-দূর থেকে স্বজনেরা আসে
ক’বছর বিয়ে হল? এখনও আসে নি কোলে কেউ?
হাতে বাঁধা লাল কার কবচ তাবিজ
মানতের ধুলো ওড়ে — এবছর কার পালি?
আগে থেকে বলে রেখো, নবমীর কলা
বিশ্বাস অচলা হলে ঘৃতাহুতি হোমে, ফল পাবে
অব্যর্থ সে আবাহন তিলে-তিলে শরীরে প্রবেশ
মহাদেব মুখচোরা, মৃদু-মৃদু হাসে!
এমন সলাজ দিনে তুমি কেন ডাক দিলে ফের
সোনার হরিণ ডাক, ঝর্ণাপ্রাণ, অবুঝ-অঝোর কুসুমের!
কবিতার বিষয় ও তার নির্মাণ চমৎকার। বাংলা শব্দভাণ্ডারে যে মণিমাণিক্য রয়েছে কবি তার উজ্জ্বল উদ্ধারের মসৃনপথ মনোগ্রাহী প্রয়াস করেছেন। এইরকম কবিতা মনন অন্তর্মহল ঋদ্ধ করে ।
অসম্ভব ভালো লাগল এই কবিতাগুচ্ছটি। সুমনদাকে অফুরন্ত শুভেচ্ছা।
ভীষণ ভাল লেখা । অনেকদিন পর তোমার লেখা সিরিজ পড়লাম । এবং বলা বাহুল্য তোমার লেখনভঙ্গি ভুলিনি এখনও । স্রোতের মতো সৈকতে বালি জমা হওয়া কবিতার পাশাপাশি স্রোতেরই টানে সৈকত ভাঙা এক আনন্দ । পুজোর আগে উৎসবকে দারিদ্র ও যন্ত্রণার সঙ্গে একসূত্রে বেঁধেছে এই লেখা । আসামান্য ।
খুব ভালো লাগল
অসাধারণ লেখা
অসাধারণ সিরিজ করেছো! এত চেনা বিষয়–কিন্তু কী অনবদ্য তার উপস্থাপনা!