‘ব্যক্তিত্বের স্টাইল স্টেটমেন্ট: রোগা দেখাতে যেও না, তুমি যেমন তেমন করেই সাজো’
চৈতালী চক্রবর্তী
“অ্যান্টি-ফিট, ওভারসাইজ জামাকাপড়ই বানাই বেশি। জানো তো, সবসময় বলি তুমি যেমন ঠিক তেমন করেই সাজো। চেহারার সঙ্গে ফুটে উঠুক ব্যক্তিত্ব। কৃত্রিমতা দিয়ে স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে ঢাকার দরকার নেই,” হাসতে হাসতেই বললেন কলকাতার নামকরা ফ্যাশন ডিজাইনার, স্টাইলিস্ট অনুপম চট্টোপাধ্যায়।
ওয়ারসি কলকাতার (Warssi Kolkata) কর্ণধার অনুপমের কিন্তু সাফ কথা, জোর করে রোগা দেখানোর কোনও দরকার নেই। চেহারার সঙ্গে মানানসই পোশাকেই মোহময়ী হয়ে উঠতে পারবেন প্লাস সাইজের তনয়ারাও। চেহারার গড়ন যেমনই হোক না কেন, সঠিক পোশাক নির্বাচন, ছিমছাম সাজ আর আত্মবিশ্বাসী মন, এই তিনের মিলমিশ হলে তুমিই হবে পুজো প্যান্ডেলের সেরা ফ্যাশনিস্তা।
অ্যান্টি-ফিট অনুপম
প্লাস সাইজ নিয়ে তো সবসময়েই চিন্তা থাকে বেশি। কোমর একটু বেশিই চওড়া বা হাতে-পিঠে মেদ সামলে কী পরব, কী পরব না, বাঙালি মেয়েরা এই ভাবনাতেই কাহিল। কী করলে রোগা দেখাবে, কোন পোশাকে কোমরের অবাঞ্ছিত মেদ ঢাকা পড়বে। বঙ্গ তনয়া মানেই সবসময় ছিপছিপে, নির্মেদ শরীরে আঁটোসাঁটো স্টাইলে অভ্যস্ত নয়। কালীদাসের ভাষায় বলতে গেলে “স্তনের ভারে ঈষৎ আনত, নিতম্বের ভারে মন্দগতি।” তবে এইসব নিয়ে বিশেষ চিন্তিত নন অনুপম। বললেন, “আমার কাছে প্লাস সাইজের অনেক অর্ডার আসে। ওভারসাইজ জামাকাপড় তৈরি করি বলে ফ্যাশনের বাজারে আমার বদনামও আছে (হেসে)। আমার তো নামই হয়ে গেছে অ্যান্টি-ফিট অনুপম!”
অ্যান্টি-ফিট মানে হল যে পোশাক শরীরের সঙ্গে আঁট হয়ে চেপে বসবে না। এককথায় কমফর্টও থাকবে, আবার স্টাইলিশও হবে। অনুপমের কথায়, এখন আর ফ্যাশন বলতে স্কিন টাইট শরীরের খাঁজ-ভাঁজ ফুটিয়ে তোলার হিড়িক নেই। তার চেয়ে ক্যাজুয়াল ওয়্যারের দিকেই বেশি ঝুঁকেছে জেন-এক্স, জেন-ওয়াই। আর করোনা আতঙ্ক যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে আর জমকালো পোশাক, ভারী গয়না আর একগাদা মেকআপে স্টাইল করার কোনও মানেই হয় না। পোশাক বাছতে হবে এমন করে যাতে বাড়িতেও পরা যায় আবার আউটডোরেও।
“এখন তো ওয়ার্ক-ফ্রম হোম করছেন বেশিরভাগই। তাই আলাদা করে একগাদা নতুন জামাকাপড় কেনার মানেই হয় না। আমি তো বলব, একটু হাল্কা ঢিলেঢালা জামাকাপড় হলেই ভাল। লং ড্রেস বা টোগার সঙ্গে একটা জ্যাকেট জড়িয়ে নাও হয়ে গেল। চুলটা হাল্কা করে বেঁধে বা খেজুর বিনুনি করে নাও, বাড়িতেই যেটা সম্ভব। এই ক্যাজুয়াল লুকেই দুরন্ত লাগবে। আর বার বার বলছি ফেস-মাস্ক কিন্তু মাস্ট, এটা ভুললে চলবে না।”– বললেন অনুপম।
কাট এবং লেয়ারিং এখন ট্রেন্ড
কাট এবং লেয়ারিং নিয়ে বরাবরই এক্সপেরিমেন্ট করেন অনুপম। বললেন, এবার লেয়ারিং ড্রেসের উপরেই বেশি জোর দিচ্ছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাশনের ভাষা বদলায়। পুরনোকে সরিয়ে নতুন আসে, আবার নতুন-পুরনো মিলেমিশে গিয়ে ফিউশন তৈরি হয়। অনুপম বললেন, ফ্যাশনের থেকে স্টাইলিংয়ে বেশি জোর দিই আমি। একটু এক্সপেরিমেন্ট হলে ক্ষতি কী। রোজকার শাড়ি-ব্লাউজের সঙ্গে যদি ওভার-দ্য টপ লেয়ারিং করা যায় তাহলে তো লুকটাই বদলে যাবে। চেহারা ভারীর দিকে হলেও সমস্যা নেই। যদি মনে হয় পেট-কোমরের মেদ একটু লুকোছাপা করে সাজব, তাহলে লং ড্রেস বা টোগা ড্রেসের সঙ্গে জ্যাকেট পরে নিলেই হল। যে লেয়ার কিনছে সে স্প্যাগেটি, ডেনিম বা ওয়েস্টার্ন পোশাকের সঙ্গেও লেয়ার করে নিতে পারে। বেশ মানাবে। একটু অন্যরকম লুক আসবে, ফিল-গুড ফ্যাক্টরও বাড়বে। পোশাক যদি মানানসই হয় তাহলে মনও চনমনে থাকে। চেহারায় তার ছাপও পড়ে। ফ্যাশনের এটাই হল মূল মন্ত্র।
“প্লাস সাইজের ক্ষেত্রে হাঁটু ঝুল খাদি কাপড়ের ফ্রকও মন্দ লাগবে না। বিকেলে প্যান্ডেলের আড্ডায় চলতে পারে হ্যান্ডলুমের বোটনেক ফ্রক। অ্যাঙ্কেল লেনথ, ঢোলা স্লিভ,” বললেন অনুপম। চওড়া পাড়ের স্কার্টও বেশ ভাল লাগবে। এর উপরে পোলকা ডটের লং শ্রাগ চাপিয়ে নিলেই স্টাইল কমপ্লিট। চট করে গলিয়ে নেওয়া যাবে, এমন ছিমছাম সাজই ভাল।
ফিটেড নয়, ফ্যাশন দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অ্যাসিমেট্রিক-কাট
কলকাতায় অ্যান্টি-ফিট পোশাকের ঘরানা মনে হয় অনুপমের হাত ধরেই হয়েছে। রোগা-পাতলা মেয়েদের জন্য শুধু টাইট-ফিটেড হট-সেক্সি লুকের পোশাককেই নিজের ব্র্যান্ড করেননি অনুপম। বরং তাঁর সিগনেচার স্টাইল হয়ে উঠেছে কমফর্ট অ্যান্টি-ফিট পোশাক। তিলোত্তমার ফ্যাশনে ঢুকে পড়েছে অ্যাসিমেট্রিক কাট। চাপাচুপি দিয়ে আর ভুঁড়ি লোকানোর দরকার নেই, প্লাস সাইজদের সুন্দর করে সাজিয়ে তোলার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন অনুপম।
বললেন, “মহেন্দ্র সিং ধোনি থেকে বিরাট কোহলি, অদিতি রাও হায়দারি থেকে চিত্রাঙ্গদা সিং সকলকেই সাজানোর সুযোগ পেয়েছি। আবীর চট্টোপাধ্যায়, শিবপ্রসাদ, গার্গী দে, পাওলি দাম, জয়া এহসান, মানালি, রাইমা, প্রিয়ঙ্কা সরকার, নুসরত অনেক নামীদামি টলি তারকাকেই সাজিয়েছি। আমি শুধু স্টাইলিস্ট নই, ফ্যাশনকে নিজের হাতে বুনি। রূপ, সাজ আর ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলাই ফ্যাশনের কারিগরদের লক্ষ্য, আমি সেটাই করি।”
প্লাস সাইজদের জন্য মিডি ড্রেস সবচেয়ে ভাল। সঙ্গে হাল্কা অ্যাকসেরিজ। যেমন ধরা যাক, ব্ল্যাক ড্রেস যদি হয় তার সঙ্গে বেল্ট লাগালে স্মার্ট লুক আসবে আর গলায় হাল্কা নেক পিস। রাতের পার্টিতেও বেশ মানিয়ে যাবে। একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রিসাইক্লিং করে পোশাক পরাই ভাল, অন্তত এ বছর, বললেন অনুপম। থ্রি-কোয়ার্টার অ্যান্টি-ফিট ফ্রকের হাতাটা একটু ফোল্ড করে যদি ব্রোচ বা স্মল পিস অফ বাটন লাগিয়ে নেওয়া যায়, চমৎকার দেখতে লাগে। লং ফ্রকের কাট যদি অ্যাসিমেট্রিক বা অসমান হয়, যেমন সামনে ঝুল কম, আর পিছনে ঝুল বেশি, কাটিং হবে এমনই যে একটু খোলামেলা থাকবে বাড়তি মেদ চাপা পড়বে। বডি শেপের সঙ্গে মানানসই কাট এবং লেয়ারিং করলে ব্যক্তিত্বও ফুটে ওঠে। আলাদা করে রোগা দেখানোর দরকার পড়ে না, বললেন অনুপম।
ছেলেদের জন্য অ্যান্টি-ফিট কুর্তা, কটনের পাঞ্জাবি-পাজামা পুজোর সকাল-সন্ধেয় বাঙালি সাজকে যেমন ফুটিয়ে তুলবে তেমনি কমফর্টের দিকেও খেয়াল রাখবে।
উজ্জ্বল রঙ মন ভাল রাখবে
চারদিকে এত প্যানিক, এই সময় একটু উজ্জ্বল রঙ মন তাজা রাখবে। সলিড কালারের জামাকাপড় পরারই পরামর্শ দিচ্ছি সকলকে, বললেন স্টাইলিস্ট অনুপম। এবারের পুজোর রঙ হতে পারে ব্ল্যাক, গ্রে, অলিভ গ্রিন, ইয়েলোর নানা শেড, গোল্ডেন ইয়েলো। প্লাস সাইজদের বিশেষ করে একটু উজ্জ্বল রঙের পোশাক পরাই ভাল। তাতে স্টাইলের সঙ্গে আকর্ষণও বাড়বে। টোন-অন-টোন স্টাইলিং এবার বেশি চলবে, বললেন অনুপম। সেটা কেমন? ধরা যাক, উজ্জ্বল হলুদ রঙের পোশাক, তার সঙ্গে হলুদ রঙের মাস্ক, সাজটা সম্পূর্ণ করবে। ফ্যাব্রিক বা প্রিন্টেড মাস্কের সঙ্গে কনট্র্যাস্ট করে পোশাক পরলে ভাল লাগবে। প্রিন্টেড বা কটন শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং মাস্ক চলবে।
এবার বেশি মেক-আপ আর অ্যাকসেসরিজে না সাজাই ভাল, বললেন অনুপম। অ্যান্টি-ফিট পোশাকের সঙ্গে হাল্কা গয়না, কাজল-আইলাইনার আর ডট বিন্দি, হোক না এবারের সাজ অন্যরকম!