ভোগের খিচুড়ির সেই অমৃতস্বাদ এবার বাড়ির রান্নাঘরেই! রইল গল্প, রেসিপি, টিপস
পাঞ্চালী দত্ত
বারোয়ারি বা বারোইয়ারি শব্দটি ‘সার্বজনীন’ শব্দের সমার্থক হিসেবে ব্যাকরণে জায়গা করে নিয়েছিল ১৭৯০ সালে। উঁচু দেওয়াল ঘেরা বিশাল অট্টালিকা কিংবা প্রাসাদের কর্তা বা জমিদারেরা যখন ইংরেজদের নজর কাড়তে এবং প্রতিবেশী জমিদারবাড়ির সঙ্গে ঐশ্বর্য্যের বড়াইয়ের লড়াইয়ে মেতে উঠতে মরিয়া, তখন প্রথম শারদীয়া দুর্গাপুজো শুরু করেন শোভাবাজার রাজবাড়ির মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব। ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতা, বিত্তের দেখনদারি ও স্বজনপোষণ ছিল বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোর মুখ্য উদ্দেশ্য। সেই রাজকীয় এবং চাকচিক্যে ভরা পুজোয় সাধারণ লোকের প্রবেশের অধিকার ছিল না। তাই প্রচলন হয় “বারোয়ারি দুর্গাপুজো”। বারো জন ইয়ার অর্থাৎ বারো বন্ধুর মস্তিষ্কপ্রসূত ভাবনা থেকেই এই বারোয়ারি দুর্গা পুজোর প্রচলন।
আর এই পুজোর একটা অন্যতম দিক হয়ে ওঠে ভূরিভোজও। এমনিতেই যে কোন উৎসব কিংবা অনুষ্ঠানে পেটপুজো ছাড়া বাঙালি অসম্পূর্ণ। তার ওপর সকলকে নিয়ে পুজোর আয়োজনে, সকলে মিলে খাওয়াদাওয়া তো অতিআবশ্যক! বিশাল অট্টালিকার যে পুজো, সেখানে ঘণ্টাধ্বনি, শাঁখের আওয়াজ, ধুনোর গন্ধ, যজ্ঞের ধোঁয়ার পাশাপাশি রসুইঘর থেকে ভেসে আসা ঘি, পোলাও, মণ্ডা মিঠাই, এলাচ-দারচিনি দেওয়া ঘন দুধের গন্ধেও চতুর্দিক মাতোয়ারা। আর এই সময়ে শহরের অন্য প্রান্তের বারোয়ারি পুজোয় সাধারণ ভাবে মানুষের জন্যে একসঙ্গে চালে ডালে ফুটছে হাঁড়ির পর হাঁড়ি খিচুড়ি, আলুভাজা আর নানারকম আনাজপাতি দিয়ে সস্তার ঘ্যাঁট। কী তার স্বাদ! সময়ের কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে সার্বজনীন ভোগের মেনু আরও বড় হতে শুরু করল। শুধু তাই ই নয়, দেখা গেল বারোয়ারি পুজোর জনপ্রিয়তা টপকে গেল বনেদিবাড়ির পুজোগুলোকেও। আর ভোগ বলতে বেশি করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল মণ্ডা-মিঠাই নয়, সাধারণের এই খিচুড়িই।
ভোগের খিচুড়ি ভাবতেই জিভ জল চলে আসে। অথচ এই খিচুড়ির মধ্যে এমন কোনও উপকরণ নেই যা অন্যান্য খিচুড়ি থেকে এর স্বাদকে আলাদা করতে পারে! তবে ভোগের খিচুড়ির কী এমন মাহাত্ম্য যা অত্যন্ত সাদামাটা ভাবে বানিয়েও সবার রসনা, মন ভরিয়ে দেয়!
আসলে সব কিছুর সবসময় সুনির্দিষ্ট কারণ হয় না। কিছু জিনিস বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। তবে খতিয়ে দেখলে দু-একটি কারণ আছে, যাতে লুকিয়ে আছে অমৃতসম স্বাদের চাবিকাঠি। প্রথমত বাসন। লোহা কিংবা পিতলের হাঁড়ি ও গামলায় খিচুড়ি রান্নায় স্বাদ অনেক পাল্টে দেয়। কারণ রান্না মানেই কিন্তু রসায়নের খেলা। যে জন্য কোনও রান্নায় মশলা আগে বা পরে দিলেও রান্নার স্বাদ অদ্ভুত ভাবে পাল্টে যায়।
ভারী পাত্র, মাটির উনুন, কাঠ কয়লার উনুন ইত্যাদিও কিন্তু স্বাদের বদল আনে অনেক রান্নায়। আর একটি কারণ আছে, একসঙ্গে বেশি খিচুড়ি রান্নার ফলে তার স্বাদ বেড়ে যায় বহুগুণ। তারও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। বলা হয়, একসঙ্গে গরম উনুনে প্রচুর পরিমাণে রান্না ও ক্রমাগত নাড়ানোর ফলে তার যে রসায়নের মেলবন্ধন ঘটে, সেটাও প্রভাব ফেলে স্বাদে।
তার পরে রয়েছে শুদ্ধ পাত্র। আমিষ বাসনে নিরামিষ রান্না করলে স্বাদের তারতম্য অনেকটাই ঘটে, সেই রসায়নের গল্পই লুকিয়ে আছে। তাই অনেক সময় অনেক চেষ্টা করেও সাদামাঠা নিরামিষ রান্নার সুস্বাদ আমরা আনতে পারি না সাধারণ পদগুলোয়।
আজ ভোগের রান্নার সেই অসাধারণ খেতে খিচুড়ির রেসিপি শেয়ার করছি আপনাদের সঙ্গে। সেই সঙ্গে দিচ্ছি ছোট দু-একটা টিপস। দেখুন তো, এই পুজোয় ভোগের খিচুড়ির স্বাদ আনতে পারেন কিনা!
ভোগের খিচুড়ি রান্না করতে লাগবে, গোবিন্দ ভোগ চাল ১ কেজি, ভেজে নেওয়া মুগডাল ১ কেজি, নারকেল দেড় খানা: ১ টা (কোরানো) আধখানা ছোট টুকরো করে তেলে ভেজে নেওয়া, জিরে গুঁড়ো, ধনে গুঁড়ো, হলুদ গুঁড়ো, লঙ্কা গুঁড়ো, কাশ্মীরি লঙ্কা গুঁড়ো, নুন, চিনি, ঘি, সর্ষের তেল, গোটা জিরে, তেজপাতা, এলাচ, দারচিনি, শুকনো লঙ্কা, কাঁচা লঙ্কা, টোম্যাটো।
প্রথমে হাঁড়িতে জল ফুটতে বসান। পিতল বা পিতল না থাকলে লোহার বাসনে রান্না করার চেষ্টা করবেন। ভাজা ডাল ধুয়ে ফুটন্ত জলে ছাড়ুন। ৫/৭ মিনিট পরে চাল দিন। দুটো এলাচ ও দু’টুকরো দারচিনি দিন। নারকেল কোরা, ঘি ও তেল দিয়ে ভেজে নিন, চাল ডালের মিশ্রণে দিয়ে দিন। নুন দিন। মাঝে মাঝে নাড়তে থাকুন। ভাজা নারকেলের টুকরোও দিয়ে দিন এবার। দিয়ে দিন কাঁচা লঙ্কা।
একটা অন্য একটা কড়াইতে সরষের তেল ও ঘি দিন। তাতে গোটা জিরে, তেজপাতা, এলাচ, দারচিনি, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিন। চিনি দিন। চিনি লাল হলে পর তাতে টোম্যাটো দিয়ে দিন কেটে। সামান্য নুন দিয়ে ঢেকে রাখুন। এবার একটা বাটিতে জিরে গুঁড়া, ধনে গুঁড়ো, হলুদ গুঁড়ো, লঙ্কা গুঁড়ো, কাশ্মীরি লঙ্কা গুঁড়ো সামান্য জল দিয়ে গুলে টমেটোতে দিন। খুব ভাল করে মশলাটা কষান। তেল যখন কড়াই ছেড়ে বেরিয়ে আসবে, তখন মশলাটা ঢেলে দিন চাল ডালের মিশ্রণে।
তবে দেখে নেবেন যে চাল ডাল পুরো সেদ্ধ হল কি না। তবেই মশলা দেবেন। তার আগে নয়। এবার ভাল করে নাড়ুন। সব যখন খুব সুন্দর করে মিশে যাবে, গ্যাস বন্ধ করুন। ঘি ছড়িয়ে দিয়ে ঢেকে রাখুন কিছুক্ষণ। এবারে পরিবেশন করুন।
রেসিপি লিখতে লিখতেই আমার জিভে জল চলে এল। কী অবাক লাগে, দুনিয়ায় এত ধরনের খাবার, কত দামী দামী খাবার রয়েছে। অথচ এই সাদামাঠা খাবারের রেসিপিটার কোনও তুলনা নেই!