কলাবউ কে! দুর্গাপুজোর সময় তাঁকে পুজো করা হয় কেন
সপ্তমীর সকালে রাস্তা থেকে ভেসে আসে ঢাকের আওয়াজ। জানলার বাইরে দৃষ্টি ভাসায় এক বালিকা। দেখতে পায় রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছেন একদল মানুষ। একজনের কাঁধে একটি কলাগাছ। ঢাকিরা তাঁর পিছনে ঢাক বাজাতে বাজাতে চলেছেন। ঢাকিদের পিছনে পিছনে শঙ্খ ও উলুধ্বনি দিতে দিতে চলেছেন লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরা মহিলারা। বালিকার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বালিকার দাদু। রাস্তার দিকে মুখ করে দুই হাত কপালে ঠেকান তিনি। বালিকার কানে ভেসে আসে দাদুর গলা, “শুরু হয়ে গেল দুর্গাপুজো”। বালিকা তার দাদুকে বলে, “ওরা কোথায় যাচ্ছে”?
দাদু বলেন, বামুন ঠাকুর গঙ্গায় কলাবউকে স্নান করাতে নিয়ে যাচ্ছেন। বালিকা আবার প্রশ্ন করে, যিনি কলা গাছ বইছেন তিনি বামুন ঠাকুর? আর ওই কলাগাছটা কলাবউ? দাদু হেসে বলেন, “হ্যাঁ”। বালিকার মনে প্রশ্নের ঝড় বয়। গতবছরও সে বিভিন্ন মণ্ডপে গণেশের পাশে লাল পাড় দেওয়া সাদা শাড়ি জড়ানো কলাগাছটাকে দেখেছে। তাহলে গণেশের বউই কি কলাবউ? প্রশ্নবাণে দাদুকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে বালিকা। দাদু বলেন, চল তোকে ব্যাপারটা খুলে বলি। নাতনিকে নিয়ে দাদু যান শিউলি তলায়। সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো লাল বেদিটাতে বসেন দাদু। চারধারে ছড়িয়ে থাকা শিউলি ফুলের গন্ধ দাদু ও নাতনিকে ঘিরে ধরে। দাদু বলতে শুরু করেন…
“দুর্গাপূজার অন্যতম অঙ্গ হল নবপত্রিকা স্নান। নবপত্রিকা মানে ভিন্ন ভিন্ন ন’টি গাছের অংশ। গাছগুলি হল কলাগাছ, কালো কচু গাছ, হলুদ গাছ, জয়ন্তী গাছ, বেল গাছ, ডালিম গাছ, অশোক গাছ, মানকচু গাছ ও ধান গাছ। এই ন’টি গাছের মধ্যে মা দুর্গার ন’টি রূপ প্রকাশ পায়। শাস্ত্রে বলেছে, “রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, কচ্বাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, জয়ন্ত্যাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা, দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুণ্ডা ও ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী।”
এর অর্থ, কলা গাছ হল দেবী ব্রহ্মাণীর প্রতীক। কালো কচু গাছ দেবী কালিকার, হলুদ গাছ দেবী উমার, জয়ন্তী গাছ দেবী কার্তিকীর, বেল গাছ দেবী শিবানীর, ডালিম গাছ দেবী রক্তদন্তিকার, অশোক গাছ দেবী শোকরহিতার, মানকচু গাছ দেবী চামুণ্ডার ও ধান গাছ মা লক্ষ্মীর প্রতীক। এই নয় দেবীকে “নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা” হিসেবে সারা বাংলায় পুজো করা হয়। নবপত্রিকার পূজা আসলে কিন্তু শস্যদেবীরই পূজা।
সপ্তমীর দিন সকালবেলায় নবপত্রিকাকে স্নান করানো হয়। সাধারণত গঙ্গা, নদী, পরিষ্কার জলাশয় বা পুকুরে নবপত্রিকাকে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হয়। নবপত্রিকাকে স্নান করাতে নানান জিনিস লাগে। সেগুলি হলো দশমৃত্তিকা, পঞ্চ অমৃত, পঞ্চশস্য, পঞ্চগব্য, পঞ্চকষায়,পঞ্চরত্নের জল,পঞ্চশস্যচূর্ণজল, সপ্তসমুদ্রের জল, সপ্ততীর্থের জল, সহস্রধারার জল, সরস্বতী নদীর জল, বৃষ্টির জল, ডাবের জল, শিশির, আখের রস, তেল-হলুদ, দন্তকাষ্ঠ, অষ্টকলস, সর্ব ঔষধি, মহা ঔষধি, পদ্মরেণু, চন্দন, তিলতৈল, বিষ্ণুতৈল, দুগ্ধ, মধু, কর্পূর, অগুরু ও চন্দন।
শাস্ত্রবিধি মেনে কলা গাছ সহ ন’টি গাছকে স্নান করিয়ে দেন পুরোহিত। স্নানের পর কলাগাছটির গায়ে বাকি আটটি গাছ ও দুটি বেলকে শ্বেত অপরাজিতার লতা দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। তারপর কলাগাছের গায়ে জড়িয়ে দেওয়া হয় নতুন একটি লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। কলা গাছের পাতাগুলিকে ঘিরে রাখা শাড়িকে ঘোমটার মতো টেনে কলা গাছকে বধূর রূপ দেওয়া হয়। কলা গাছ হয়ে যায় ‘কলাবউ’।
আবার বাজতে থাকে কাঁসর, ঢাক, শঙ্খ। শুরু হয় উলুধ্বনি। পুরোহিত কাঁধে করে কলাবউকে নিয়ে আসেন মণ্ডপে। মণ্ডপে কলাবউ বা নবপত্রিকাকে প্রবেশ করানোর আগে, কলাবউয়ের সামনে দেবী চামুণ্ডার আবাহন ও পূজা করা হয়। দেবী চামুণ্ডার আবাহনের পর, দেবী দুর্গার ডান দিকে, শ্রী গণেশের পাশে পাতা একটি জলচৌকিতে, নবপত্রিকা বা কলাবউকে স্থাপন করেন পুরোহিত। এর পরই শুরু হয় দেবী দুর্গার মহাস্নান। নিষ্ঠাভরে শুরু হয়ে যায় দেবী দুর্গার আরাধনা। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে দেবী দুর্গা ও তাঁর চার সন্তানের সঙ্গেই পুজো পান কলাবউ বা নবপত্রিকা।”
অনেকটা বলার পর থামেন দাদু। দাদুর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা নাতনি বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে বলে, দাদু একটা প্রশ্নের উত্তর তো দিলেনা। কলাবউ কি গণেশের বউ? দাদু হেসে বলেন, “না রে, গণেশের বউয়ের নাম তো বুদ্ধি, ঋদ্ধি ও সিদ্ধি। কলাবউ তো মা দুর্গারই ন’টি রূপের সমাহার। তাই কলাবউ কী করে গনেশের বউ হবেন! কলাবউ যে গণেশের জননী।”
সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে নাতনির মুখে শরতের সূর্যের মতই ফুটে ওঠে অনাবিল হাসি। দূরের কোনও মণ্ডপ থেকে ভেসে আসে ঢাক, কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ। সেদিকে ফিরে হাতদুটি কপালে ঠেকান দাদু। বিড়বিড় করে বলতে থাকেন, “জয় মা দুর্গা, জয় মা দুর্গা”। সেসময় দাদুকেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষ বলে মনে হয় নাতনির।
সপ্তমী তিথি
বাংলা তারিখ– ৫ ই কার্তিক, ১৪২৭, বৃহস্পতিবার।
ইংরেজি তারিখ– ২২/১০/২০২০
সময়– দুপুর ১ টা ১২ মিনিট ১১ সেকেন্ডে সপ্তমী পড়বে।
পূর্বাহ্নের মধ্যে চরলগ্নে ও চরণবাংশে, কিন্তু বারবেলানুরোধে সকাল ৮টা ৩০ মিনিট ২৮ সেকেন্ড মধ্যে শ্রীশ্রী শারদীয়া দুর্গাদেবীর নবপত্রিকা প্রবেশ, স্থাপন, সপ্তম্যাদিকল্পারাম্ভ ও সপ্তমীবিহিত পূজা প্রশস্তা।
রাত ১০টা ৫৬ মিনিট ৪৯ সেকেন্ড থেকে ১১টা ৪৪ মিনিট ৪৯ সেকেন্ডের মধ্যে দেবীর অর্ধরাত্রবিহিত পূজা।
সপ্তমী তিথি শেষ:
বাংলা তারিখ – ৬ কার্তিক , ১৪২৭, শুক্রবার।
ইংরেজি তারিখ– ২৩/১০/২০২০
সূর্যোদয়- ঘ ৫/৪১, সূর্য্যাস্ত ঘ ৫/৩, পূর্বাহ্ন ঘ ৯/২৮
সময়– বেলা ১২ টা ৪ মিনিট ১৯ সেকেন্ডে পর্যন্ত সপ্তমী থাকবে।