দশপ্রহরণধারিণী দুর্গার দশ অস্ত্রের মাহাত্ম্য
তখন স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালের অধিপতি মহিষাসুরের অত্যাচারে দেবতারা স্বর্গের অধিকার হারিয়ে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত। অসুরকুলের উৎপীড়নে পৃথিবীতে দেবতাদের উপাসনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছিল। তখন ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর ও সকল দেবতার তেজরশ্মির মিলনে আবির্ভূতা হয়েছিলেন দশভুজা দুর্গা।
দেবী দুর্গার দশভুজা হওয়ার পিছনে নির্দিষ্ট কারণ আছে। জ্যোতিষশাস্ত্র মতে দিকের সংখ্যা দশ। এই দশটি দিক হল কুবের (উত্তর), যম (দক্ষিণ), ইন্দ্র(পূর্ব,), বরুণ(পশ্চিম), ঈশান(উত্তর-পূর্ব), বায়ু (উত্তর-পশ্চিম) অগ্নি (দক্ষিণ-পূর্ব), নৈর্ঋত(দক্ষিণ-পশ্চিম), ব্রহ্মা (ঊর্ধ্ব) ও বিষ্ণু (অধঃ)। মহিষাসুরের হাত থেকে এই দশদিককে রক্ষা করার জন্য মায়ের অঙ্গে দশটি বাহুর সৃষ্টি হয়েছিল। দেবীর দশ হাতে উঠে এসেছিল দশটি অস্ত্র। মা হয়েছিলেন দশপ্রহরণধারিণী।
নৃশংস মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠানোর আগে দশভুজা দেবীকে রণসাজে সজ্জিত করা হয়েছিল। ব্রহ্মা দিয়েছিলেন কমণ্ডলু, অক্ষমালা। বিশ্বকর্মা দিয়েছিলেন কবচকুণ্ডল ও অক্ষয় বস্ত্র। দেবীকে তাঁর কাঞ্চনবর্ণ প্রদান করেছিলেন সূর্য। দেবীর অঙ্গ অলঙ্কারে সাজিয়ে দিয়েছিলেন কুবের। কোটি চন্দ্রের শোভা দিয়েছিলেন দেবতারা। রণক্ষেত্রে যাওয়ার বাহন হিসেবে গিরিরাজ হিমালয় দেবীকে দিয়েছিলেন এক ভয়াল ভয়ঙ্কর সিংহ।
এর পর মায়ের দশ হাতে দেবতারা তুলে দিয়েছিলেন মহিষাসুর বিনাশের দশ অস্ত্র। দুর্গা প্রতিমা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় মহিষমর্দিনী কিংবা সিংহবাহিনী রূপে গড়া হয়। দুর্গা প্রতিমার হাতে থাকা দশ অস্ত্র ভারতের সব জায়গায় সমান হয় না। কোথাও মা দুর্গা আট হাতে অস্ত্র ধারণ করেন, বাকি দুই হাতে ত্রিশূল ধারণ করে আঘাত করেন মহিষাসুরের বুকে। কোথাও নয় হাতে অস্ত্র থাকে, এক হাত থাকে বরাভয় মুদ্রায়। কোথাও বা দশ হাতেই থাকে অস্ত্র। তবে অস্ত্রের সংখ্যা ও প্রকারে সামান্য কিছু পার্থক্য দেখা গেলেও মূল অস্ত্রগুলি দুর্গাপ্রতিমার হাতে থাকে।
শঙ্খ
ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম নিয়ে গড়ে ওঠা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ‘অপ’ হল জল। জলাধিপতি বরুণদেব মা দুর্গাকে দিয়েছিলেন শঙ্খ। সনাতন ধর্মে শঙ্খ হল জীবজগতের স্পন্দনের প্রতীক। আবার এই শঙ্খই ত্রিলোকে জাগরণের প্রতীক। ভয়াবহ শঙ্খনিনাদের মাধ্যমে দেবী মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করেছিলেন।
চক্র
শ্রীবিষ্ণু দেবী দুর্গার হাতে তুলে দিয়েছিলেন ১০৮টি ধার যুক্ত শাণিত সুদর্শন চক্র। সুদর্শন চক্রটি শ্রীবিষ্ণুর জন্যে তৈরি করেছিলেন বিশ্বকর্মা। ত্রিলোকের সকল অন্যায় ও অশুভ শক্তির দমন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতীক এই সুদর্শন চক্র। এই অস্ত্র নিজে থেকে চালিত হয়ে সকল অশুভের বিনাশ ঘটিয়ে ধরাধামে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করে। তাই দেবী দুর্গার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল সুদর্শন চক্র।
গদা বা কালদণ্ড
মহিষাসুর নিধন যজ্ঞে দেবীকে কালদণ্ড প্রদান করেছিলেন ধর্মরাজ যম। পাপকে মাফ করে না কাল। ত্রিলোকের শুভ ও অশুভ সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে কাল। তাই কালকে শ্রদ্ধা ও সমীহ করা হয়। অশুভ শক্তিরা কালের দর্শনে ভীত হয়। তাই দণ্ডবিধানকারী মহাশক্তি হিসেবে দেবী দুর্গার হাতে স্থান পেয়েছে কালদণ্ড।
পদ্ম
দেবী দুর্গার হাতে পদ্ম তুলে দিয়েছিলেন পদ্মযোনি ব্রহ্মা। পঙ্ক বা পাঁকে জন্মায় বলে পদ্মের নাম পঙ্কজ। পাঁকে জন্মালেও পদ্মের সৌন্দর্য ও পবিত্রতাকে কলুষিত করতে পারেনা পাঁক। তাই পদ্ম অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রার দিশারি। মহিষাসুরকে বধ করে, ঘনঘোর অমানিশাকে দূরে সরিয়ে, মা দুর্গা বসুন্ধরাকে আলোকোজ্জ্বল করে তুলবেন। সেই কামনায় প্রজাপতি ব্রহ্মা দেবী দুর্গার হাতে তুলে দিয়েছিলেন পদ্ম।
ধনুর্বাণ
দূর থেকে লক্ষ্যভেদের অমোঘ অস্ত্র হিসেবে দেবী দুর্গার হাতে ধনুর্বাণ তুলে দিয়েছিলেন বায়ুমণ্ডলের দেবতা পবনদেব। ঋণাত্মক শক্তি এবং স্থির লক্ষ্যের প্রতীক হলেও ধনুর্বাণ ইতিবাচক শক্তিকে প্রকাশ করে। তাই মহিষাসুরকে বিনাশ করে বিশ্ব সংসারকে রক্ষা করার জন্যেই দেবীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল ধনুর্বাণ।
খড়্গ
খড়্গ হল বলি প্রদানের অস্ত্র, এবং অশুভশক্তির বলিতেই শুভশক্তি জাগ্রত হয়। তাই দেবী দুর্গার হাতে থাকে উদ্যত ও অভয় প্রদানকারী খড়্গ। দেবীর হাতে খড়্গ তুলে দিয়েছিলেন সিদ্ধিদাতা গণেশ। মহিষাসুরকে বধ করে, মহিষাসুরের জন্য ত্রিলোকে নেমে আসা অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে দেবেন দেবী, সেই কামনায় দেবীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল খড়্গ।
বজ্র
দেবরাজ ইন্দ্র দেবীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন বজ্র। দধীচি মুনির অস্থি দিয়ে তৈরি এই বজ্র দিয়েই স্বর্গদখলকারী বৃত্তাসুরকে হত্যা করেছিলেন ইন্দ্র। বজ্র আকস্মিক মারণাঘাত হানতে পটু। অন্যদিকে বজ্র কঠোরতার প্রতীক।
নাগপাশ
যুদ্ধের প্রাক্কালে দেবাদিদেব মহাদেব ( মতান্তরে বরুণ অথবা শেষনাগ) দেবীকে দিয়েছিলেন নাগপাশ। নাগপাশ হল বিশুদ্ধ চেতনা এবং মহাদেবের অপরিমিত তেজ ও পৌরুষের প্রতীক। মা দুর্গার সঙ্গে যুদ্ধরত মহিষাসুর ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ বদলে ফেলায় সমস্যায় পড়তে হয়েছিল দেবী দুর্গাকে। তখন মহিষাসুরের দিকে নাগপাশ নিক্ষেপ করেছিলেন দেবী। নাগপাশের করাল আলিঙ্গনে বন্দি হয়েছিল মহিষাসুর। দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ভল্ল
দেবীকে জ্বলন্ত ভল্ল দিয়েছিলেন (বর্শা বা বল্লম) অগ্নিদেব। একই সঙ্গে জ্ঞান ও অপরিমিত তেজপুঞ্জের প্রতীক হলো ভল্ল।
ঢাল ও পরশু (কুঠার)
দেবীকে বিশ্বকর্মা দিয়েছিলেন ঢাল ও কুঠার। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে সুরক্ষা দেওয়ার প্রতীক হল ঢাল এবং অশুভশক্তি সংহারের প্রতীক হলো কুঠার।
ত্রিশূল
সবশেষে, মা দুর্গার হাতে মহাদেব তুলে দিয়েছিলেন তাঁর ত্রিকাল দণ্ড বা ত্রিশূল। ত্রিগুণের প্রতীক হলো ত্রিশূল। যার তিনটি ফলায় বিরাজ করছে তিনটি গুণ সত্য, রজোঃ ও তমঃ। সত্য গুণে দৈবশক্তি, রজোঃ গুণে মনুষ্যশক্তি ও তমঃ গুণে অশুভ বা আসুরিক শক্তি প্রকাশিত হয়। তমঃ গুণ নাশ করার অব্যর্থ অস্ত্র হল এই ত্রিশূল। ক্রোধ, লালসা, প্রতারণা, হিংসা, নৃশংসতা, জিঘাংসা, রিরংসা ও বিলাসিতার দোষে মহিষাসুর হয়েছিল তমঃ গুণে পরিপূর্ণ। তাই মহিষাসুরের বিনাশে ত্রিশূলই হয়ে উঠেছিল ব্রহ্মাস্ত্র।