দশকর্মার বাজার করা দুর্গাপুজোর সবচেয়ে কঠিন কাজ, কী কী থাকে সেই ফর্দে
দুর্গাপূজার সবচেয়ে কঠিন কাজটি হল ঠাকুরমশাইয়ের দেওয়া ফর্দ মিলিয়ে দশকর্মা ভাণ্ডার থেকে পুজোর উপকরণ কিনে আনা। পুজো করতে বসার আগেই ফর্দ ধরে পুজোর উপকরণ মেলাতে বসেন ঠাকুরমশাই। না মিললেই চিত্তির। হুঙ্কার ছেড়ে কোনও কোনও ঠাকুরমশাই বলে দেন, সব উপকরণ না পেলে তিনি পুজোই করবেন না। মায়ের পুজো তো আর ছেলেখেলা নয়। প্রতিমা, থিম, লাইট, মাইক, ফাংশানের দিকে উৎসাহের কমতি নেই, উৎসাহের অভাব শুধু মায়ের পুজোর উপকরণ কেনাকাটার দিকে।
কে না জানেন, পুজোর সময় বাঙলার সবচেয়ে দামি মানুষটি হল পুরোহিত। তাঁকে চটালে মুশকিল। তাই ঊর্ধ্বশ্বাসে বাজারের দিকে ছুটতে শুরু করে সাইকেল ও মোটরসাইকেল। মহার্ঘ উপকরণটি যে আগে পাবে, সে কিনে বাকি টিমকে ফোন করবে। এভাবেই চার পাঁচটা বাইকের তেল পুড়িয়ে দশকর্মা ভাণ্ডার থেকে মণ্ডপে আসে, হয়তো পাঁচ টাকা দামের ভুলে যাওয়া উপকরণ।
তাই দুর্গাপুজো শুরু হওয়ার অনেক আগেই ফর্দ মিলিয়ে পুজোর উপকরণ কিনে রাখতে হবে। আজকাল অবশ্য অনলাইনেও পাওয়া যাচ্ছে দুর্গাপূজার উপকরণ। মহিষমর্দিনীর মহাপূজায় প্রায় একশোরও বেশি উপকরণ লাগে। তাই পুজোর উপকরণ কেনা ও ভাগ করার বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। প্রত্যেক দিনের প্রত্যেক পুজোর উপকরণ আলাদা আলাদাভাবে পিচবোর্ডের বাক্সে রেখে বাক্সের গায়ে স্টিকার মেরে দিলে খুঁজে পেতেও সুবিধা হবে।
দুর্গাপূজার শুরু হয় ‘কল্পারম্ভ‘ দিয়ে। কল্প শব্দের অর্থ এখানে ‘সংকল্প‘। কোথাও আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে, কোথাও প্রতিপদ তিথিতে, আবার কোথাও কোথাও ষষ্ঠী তিথিতে ‘কল্পারম্ভ‘ করা হয়ে থাকে। এর পর আসে মহাষষ্ঠীর বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস। সপ্তমীতে নবপত্রিকা স্নান ও মহাস্নান সপ্তমীর পূজা। এরপর একে একে আসে অষ্টমী পূজা, সন্ধিপূজা, নবমী পূজা ও দশমী পূজা। এবার জেনে নেব মায়ের আরাধনায় প্রথম দিন থেকে শেষদিন পর্যন্ত যে যে উপকরণ লাগবে সে সবের ফর্দ।
মহাষষ্ঠীর উপকরণ
কল্পারম্ভের উপকরণ – পঞ্চপল্লব, পঞ্চরত্ন, পঞ্চশস্য, পঞ্চগব্য, ঘট ও কুণ্ডহাঁড়ি, সিন্দূর, পঞ্চবর্ণের গুঁড়ি, দর্পণ (একটি), আতপ তণ্ডুল( একসরা), তেকাঠি(একটি), তিরকাঠি(চারটি), শিষ ডাব (একটি), তিল, হরিতকী, পুষ্পাদি, চন্দ্রমালা, দধি, মধু, ঘৃত, চিনি, প্রধান নৈবেদ্য(তিনটি), কুচা নৈবেদ্য( একটি), ঘট ঢাকার গামছা (একটি), চণ্ডীর শাড়ি (একটি), বিষ্ণুর ধুতি (একটি), কল্পারম্ভের শাড়ি (একটি), আসনাঙ্গুরীয়ক (তিনটি), মধুপর্কের বাটি (তিনটি) এবং ভোগের উপকরণ।
বোধনের উপকরণ –বিল্ববৃক্ষ বা একজোড়া বেল সহ বেলডাল (একটি), পঞ্চগুঁড়ি, পঞ্চগব্য, পঞ্চশস্য, পঞ্চরত্ন, পঞ্চপল্লব, বোধনের শাড়ি (একটি), বিল্ববৃক্ষ পূজার ধুতি (একটি), ঘট (একটি) , আতপ তণ্ডুল (একসরা), ঘটাচ্ছাদন গামছা (একটি), শিষ ডাব (একটি), তির কাঠি (চারটি), আসনাঙ্গুরীয়ক (দু‘টি), মধুপর্কের বাটি (দু‘টি/দশটি) ,দধি, ঘৃত, পুষ্পাদি, তিল, হরিতকী, মাষভক্ত বলি (একটি), প্রধান নৈবেদ্য (দু‘টি), কুচা নৈবেদ্য (একটি), ছুরি (একটি), চাঁদমালা (একটি) এবং ভোগ ও আরতির উপকরণ।
আমন্ত্রণের উপকরণ – আমন্ত্রণের শাড়ি (একটি), মধুপর্কের বাটি (একটি), দধি, মধু, চিনি, ঘৃত, পুষ্পাদি, নৈবেদ্য (একটি), তিল, হরিতকী (একটি), আসনাঙ্গুরীয়ক (একটি),
অধিবাসের উপকরণ – তেল, হলুদ, মহী বা গঙ্গামাটি, গন্ধ, শিলা, স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, শঙ্খ, কজ্জল, গোরোচনা, ধান্য, দূর্বা, পুষ্পাদি, শ্বেত-সরিষা, দর্পণ, আলতা, হরিদ্রাসূত্র, লৌহ, চামর, দীপ, তির, অখণ্ড কদলী (একছড়া), দধি, ঘৃত, স্বস্তিক (পিটুলি নির্মিত), সিন্দূর ও আরতির উপকরণ।
মহাসপ্তমীর উপকরণ
সপ্তমী পূজার উপকরণ – মূলপূজার শাড়ি এবং লক্ষ্মী, সরস্বতী, চণ্ডী, কার্তিকেয়, গণেশ, শিব, বিষ্ণু, নবগ্রহ ( ৯ /১), ময়ূর, মূষিক, সিংহ, অসুর, মহিষ, বৃষ, সর্প, জয়া, বিজয়া, শ্রীবিষ্ণু, মহাদেব ও শ্রীরাম প্রভৃতি প্রত্যেকের বস্ত্র। নবপত্রিকার পরিধেয় শাড়ি, নবপত্রিকা পূজার শাড়ি ( ৯ / ১)। গুরু, পুরোহিত, পূজক ও আচার্য্যের জন্য চার জোড়া বরণবস্ত্র। এছাড়া ঘটাচ্ছাদন গামছা (দুটি), আরতির গামছা ( একটি)। আসনাঙ্গুরীয়ক ( ৪০ / ২২), মধুপর্কের বাটি ( ৪০/ ২২/ ১), মধু, চিনি, নৈবেদ্য ( ৪০ /২২), প্রধান নৈবেদ্য (একটি), অর্ঘ্য, চন্দ্রমালা, থালা (একটি), ঘটি (একটি), নথ (একটি), লোহা(একটি), শঙ্খ (দুটি), সিন্দূর চুবড়ি (একটি), কুণ্ডহাঁড়ি (একটি), তেকাঠা (একটি), প্রধান দীপ (একটি), দর্পণ (একটি) ,বরণাঙ্গুরীয়ক ও যজ্ঞোপবীত (চারটি), তিল, হরিতকী, পুষ্পাদি, ঘট (একটি), শিষ ডাব(একটি), আতপ তণ্ডুল ( দুই সরা), বিল্বপত্র, পঞ্চগুঁড়ি, পঞ্চরত্ন, পঞ্চশস্য, পঞ্চপল্লব, সিন্দূর, শ্বেত সরিষা , মাষকলাই, জবাপুষ্প,পুষ্পমাল্য, বিল্বপত্রমালা, গোরোচনা, ফলমূলাদি, ভোগ ও আরতির উপকরণ।
নবপত্রিকার উপকরণ – কলাগাছ (একটি), মানকচু গাছ (একটি), কালকচু গাছ (একটি), ধানগাছ (একটি), হরিদ্রাগাছ (একটি), অশোকডাল (একটি), জয়ন্তীডাল (একটি), একজোড়া বেল সহ বেলডাল (একটি), ডালিমডাল (একটি), শ্বেত অপরাজিতা লতা, কলার পেটো (দু‘টি), রক্তসূত্র, আলতা, পাটের দড়ি।
মহাস্নানের উপকরণ – দশমৃত্তিকা(গঙ্গামৃত্তিকা, নদীর উভয়কূলমৃত্তিকা, বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা, গজদন্তমৃত্তিকা, বরাহদন্তমৃত্তিকা, চতুষ্পথমৃত্তিকা, রাজদ্বারমৃত্তিকা, বল্মীকমৃত্তিকা, বৃষশৃঙ্গমৃত্তিকা এবং পর্বতমৃত্তিকা), তৈল, হরিদ্রা, দন্তকাষ্ঠ, কলস (আটটি), সপ্তসমুদ্রের জল, সহস্রধারার জল, সরস্বতী নদীর জল, পঞ্চরত্নমিশ্রিত জল, পঞ্চশস্যচূর্ণজল, বৃষ্টির জল, উষ্ণোদক, নারিকেলোদক, শিশিরোদক, মাগরোদক, পদ্মরেণুদক, ফলোদক (ডাবের জল), নির্ঝরোদক, পঞ্চগব্য, পঞ্চামৃত, পঞ্চকষায়, ইক্ষুরস, তিলতৈল, বিষ্ণুতৈল, দুগ্ধ, মধু, কর্পূর, অগুরু, চন্দন, কুঙ্কুম, সর্ব্বৌষধি ও মহৌষধি।
মহাঅষ্টমীর উপকরণ
অষ্টমী পূজার উপকরণ – মহাস্নান দ্রব্য, মূল পূজার শাড়ি (একটি), দন্তকাষ্ঠ (একটি), আসনাঙ্গুরীয়ক ( ৪০/২২/ ১), মধুপর্কের বাটি ( ৪০/২২/ ১), চন্দ্রমাল্য, পুষ্পমাল্য, বিল্বপত্রমাল্য, ঘড়া বা ঘটি (একটি), থালা (একটি), নথ (একটি), লোহা, শাঁখা (দুটি), গোরোচনা, সিন্দূর চুবড়ি (একটি), পুষ্পাদি, দধি, মধু, ঘৃত, চিনি, প্রধান নৈবেদ্য ( ৪০ / ২২), কুচা নৈবেদ্য(চারটি), ভোগের ও আরতির উপকরণ।
কুমারী পুজোর উপকরণ- কোথাও কোথাও অষ্টমীর দিন কোথাও নবমীর দিন কুমারী পূজা করা হয়। আসন, স্বাগত, পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, মধুপর্ক, স্নানীয়, বসন, আভরণ, গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য, আচমনীয়, তাম্বুল, এই ষোলো প্রকার উপচার বা উপকরণ দিয়ে কুমারী পূজা হয়। কোথাও আবার গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ ও নৈবেদ্য অর্থাৎ পঞ্চোপচারে কুমারী পূজা করা হয়।
সন্ধিপূজার উপকরণ- স্বর্ণাঙ্গুরীয়ক (একটি), লোহা ও নথ (একটি), চেলির শাড়ি (একটি), শাড়ি (একটি), মধুপর্কের কাঁসার বাটি (একটি), থালা (একটি), ঘড়া (একটি), দধি, চিনি, মধু, ঘৃত, প্রধান নৈবেদ্য (একটি), কুচা নৈবেদ্য (একটি),বালিশ (একটি), মাদুর (একটি), চন্দ্রমাল্য(একটি), দীপ ১০৮ টি, পুষ্পাদি, ভোগ ও আরতির উপকরণ।
নবমী পূজার উপকরণ
মহাস্নানের দ্রব্য, দন্তকাষ্ঠ, সিন্দgর চুবড়ি (একটি), লোহা(একটি), শাঁখা (দু‘টি), নথ(একটি), মূলপূজার শাড়ি (একটি), চণ্ডীর শাড়ি (একটি), আসনাঙ্গুরীয়ক, মধুপর্কের বাটি, দধি, মধু, ঘৃত, চিনি, প্রধান নৈবেদ্য (৪০ / ২২), কুচা নৈবেদ্য ( চারটি), থালা (একটি), ঘটি (একটি), চন্দ্রমাল্য, পুষ্পমাল্য, গোরোচনা, পান, পানের মশলা, পুষ্পাদি, হোমের বিল্বপত্র, হোমের দ্রব্যাদি, পূর্ণপাত্র, দক্ষিণা ও আরতির উপকরণ ।
দশমী পূজার উপকরণ
দশমীর সকালে দশোপচারে পূজা হয়। এগুলি হলো পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, স্নানীয়, পুনরাচমনীয়, গন্ধ, পুষ্পাদি, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য। এছাড়াও দধি, মুড়কি, মিষ্টান্ন, সিদ্ধি ও আরতির উপকরণও লাগে পুজোর সময়।
এই হল দুর্গাপুজোর গড়পড়তা ফর্দ। তবে এলাকা বিশেষে ফর্দের উপকরণ পালটে যেতে পারে। তাই স্থানীয় পুরোহিতের সঙ্গে আলোচনা করেই ফর্দ করা উচিত। উপরের তালিকায় তিনি তাঁর মতো সংযোজন ও বিয়োজন করে নেবেন। তবে একটা কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, পুজোর বেশ কিছুদিন আগে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ফর্দ মিলিয়ে কেনাকাটা করে রাখলে পুজোর সময় বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না।