দুর্গাপুজোয় পর্দানশীন থাকেন বিদ্যাসাগরের স্নেহধন্য বর্ধমানের সিংহরায় পরিবারের মহিলারা
সর্বশক্তিরূপেণ দেবী রূপেই পুজিতা হন দুর্গা। তবুও সেই শক্তির আরাধনার সময়েই পর্দানশীন থাকতে হয় জামালপুরের চকদিঘির সিংহরায় জমিদার বাড়ির মহিলাদের। এক সময়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সাহচর্য্য পাওয়া এই জমিদার পরিবারের মহিলাদের আজও শুধুমাত্র আভিজাত্য বজায় রাখতেই এমন নিয়ম মেনে চলতে হয়।
ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বকালে বাংলায় জমিদারি ব্যবস্থার পত্তন হয়। সেই সমসাময়িক কালের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে জামালপুরের চকদিঘির জমিদারদের নামও। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জমিদারি প্রথা বিলীন হয়ে গেলেও প্রায় ৩৭০ বছর ধরে চকদিঘির বাগানবাড়ি সেই জমিদারি ঐতিহ্যের ধারা বহন করে চলেছে।
একশো বিঘা জমি জুড়ে রয়েছে জমিদারদের বাগানবাড়ি। যার কোণায় কোণায় ছড়িয়ে রয়েছে জমিদারি রাজত্বের নানা নিদর্শন। ঐতিহ্য পরম্পরা মেনে এই বাগানবাড়ির সুবিশাল মন্দিরে ২৮৪ বছর ধরে পুজিতা হয়ে আসছেন দেবী দুর্গা। একসময়ে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দুর্গাপুজোয় এসে থাকতেন এই বাগান বাড়িতে। কিংবদন্তি চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ তাঁর সিনেমার শ্যুটিংয়ের জন্য এই বাগান বাড়িকেই বেছে নিয়েছিলেন। জমিদারি আর নেই। তবে আভিজাত্যের গড়িমা অটুট রেখেছেন চকদিঘীর জমিদার সারদপ্রসাদ সিংহরায়ের উত্তরসুরীরা ।
চকদিঘির জমিদারদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন রাজপুত ক্ষত্রিয়। ইতিহাস প্রসিদ্ধ বুন্দেলখণ্ডের শাসকদের বংশধররা এখানে জমিদারি চালাতেন। দুর্গাচরণ রায়ের ‘দেবগণের মর্ত্যে আগমন’ বইয়ে উল্লেখ রয়েছে চকদিঘির জমিদারদের কথা। তা থেকে জানা যায়, রাজস্থান থেকে চকদিঘিতে সর্বপ্রথম এসে ছাউনি ফেলেছিলেন নল সিং। সেখানেই তিনি বসবাস শুরু করেছিলেন। পরবর্তী কালে জমিদারি স্বত্ব লাভের পর নল সিং অগাধ ঐশ্বর্য্য ও খ্যাতি লাভে সমর্থ হন।
কথিত আছে, এই জমিদারি তিনি লাভ করেছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে। দামোদরের পূর্ব তীরের শুড়া মৌজার হাজামজা জলাশয় ও দিঘি-সহ নিষ্কর জমিই পরবর্তীকলে পরিচিতি পায় চকদিঘি নামে। এই জমিদার বংশের খ্যাতি শীর্ষে পৌঁছেছিল সারদাপ্রসাদ সিংহরায়ের হাত ধরে। প্রজাবৎসল জমিদার সারদাপ্রসাদ তাঁর জমিদারি এলাকার প্রভূত উন্নতি সাধনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। শিক্ষাবিস্তারের জন্য তিনি চকদিঘিতে তৈরি করেছিলেন বিদ্যালয়। যে বিদ্যালয়ের উদ্বোধন করেছিলেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এছাড়াও চকদিঘি হাসপাতাল এবং আজকের মেমারি চকদিঘি সড়কপথ সবই তৈরি হয়েছিল সারদাপ্রসাদ সিংহরায়ের একান্ত উদ্যোগে।
জানা যায়, জমিদার হয়েও ভোগবিলাসকে তুচ্ছ করে তিনি জনসেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। প্রজারা একান্তভাবেই ছিলেন সারদাপ্রসাদ সিংহরায়ের গুণমুগ্ধ। জমিদার বংশের পরবর্তী প্রজন্ম ললিতমোহন সিংহরায়, লীলামোহন সিংহরায় প্রমুখরাও সারদাপ্রসাদ সিংহরায়ের পথ অনুসরণ করে জমিদারি চালিয়েছিলেন। বর্তমান বংশধর অম্বরীশ সিংহরায় একই ভাবে পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য বজায় রেখেই চলতে আগ্রহী।
বাগান বাড়ির ভিতর কাছাড়ি বাড়ির সামনেই রয়েছে দুর্গা পুজোর স্থায়ী মন্দির। মন্দিরের সঙ্গেই রয়েছে টিনের ছাউনি দেওয়া বিশাল আকার বসার জায়গা। জমিদার বাড়ির কেয়ারটেকার সুশান্ত দত্ত জানান, এই পরিবারের আরেকটি দুর্গা মন্দির রয়েছে চকদিঘি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে মণিরামবাটি গ্রামে। সেখানকার মন্দিরটিও একই আদলে তৈরি। সেখানেও জমিদারি ঐতিহ্য মেনে পুজোর যাবতীয় আয়োজন করা হয়। পঞ্জিকার সময় সারণী মেনে একই সময়ে দুই ঠাকুর মন্দিরে পুজো হয়। ব্যবসা ও কর্মসূত্রে সিংহরায় পরিবারের বর্তমান সদস্যরা বছরের বাকি দিনগুলিতে কলকাতা ও দেশের অন্যত্র থাকেন। তবে পুজোর ক’টাদিন গোটা পরিবার একত্রিত হন চকদিঘির বাগান বাড়িতে।
বৈদিক মতে দুর্গা আরাধনা হয় সিংহরায় বাড়িতে। একচালার কাঠামোয় ডাকের সাজে প্রতিমা সাজানো হয়। দেবী মূর্তির দু’পাশে বসানো থাকে জয়া ও বিজয়া নামে দুই পরীর মূর্তি। মন্দিরচত্ত্বর সাজানো হয় এক ভিন্ন আঙ্গিকে। একটি গোটা নারকেল, আমপাতা ও একটি করে কাঁঠালি কলা একসঙ্গে বাঁধা থাকে মন্দির চত্বরের প্রতিটি থামে। প্রতিপদের দিন থেকে শুরু হয় পুজো। পঞ্জিকার নির্ঘন্ট মেনে পুজো করেন হুগলির বাসিন্দা কূলপুরোহিত ভোলানাথ চতুর্বেদি।
পুজোয় অন্য ফল যাই থাক কাজু, কিসমিস, পেস্তা, আখরোট ও মেওয়া ফল চাইই। নৈবেদ্য সাজানো হয় চিনির সন্দেশ, ছোট ও বড় মুণ্ডি, ডোনা, নবাত, রসকড়া, মুড়কি দিয়ে। পারিবারিক নিয়ম মেনে স্থলপদ্মে হয় দেবীর পুজো। একমাত্র সন্ধিপুজোয় লাগে ১০৮ টি জলপদ্ম। পুজোর প্রতিটি দিন দেবীর কাছে নিবেদন করা হয় হরেক রকম নিরামিশ ভোগ । মহাষ্টমীর দিন থেকে পুজোর নৈবেদ্যে দেওয়া হয় মাখা সন্দেশ।
আগে ছাগ বলি হলেও বেশকয়েক বছর হল বলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পরিবর্তে এখন সন্দেশ নিবেদন করা হয়। জমিদার বাড়ির পুজোর জোগাড়ে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ। সবকিছুই করেন জমিদার বংশের পুরুষরা। সবথেকে আশ্চর্য্যের বিষয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যাতায়াত ছিল যে বাড়িতে, সেই সিংহরার পরিবারের মহিলারা এখনও পুজোয় পর্দানশীন থাকেন।
জমিদার পরিবারের বর্তমান বংশধর অম্বরিশ সিংহরায় বলেন , “অন্দর মহল থেকে পরিবারের মহিলারা মন্দিরে পুজো দিতে কিংবা ঠাকুর দেখতে আসার সময় তাদের পথের দু’পাশ আড়াল করার জন্য কাপড় দিয়ে ‘কানাত’ টাঙানো হয়। পুজোর সময় আমাদের বাড়ির বউরা পর্দার পেছনে থাকেন। বংশ পরম্পরায় এই ঐতিহ্য মেনে আসা হচ্ছে। এখনও জমিদার বাড়ির বউদের মুখ অন্য কেউ যাতে দেখতে না পায় তাই এই ব্যবস্থা। প্রথা মেনে একাদশীতে কাঙালি বিদায় পর্ব শেষে পুজোর সমাপ্তি ঘটে চকদিঘির জমিদার বাড়িতে ।