৩৬১ দিন ব্যাঙ্কের লকারে থাকেন মা দুর্গা, শারদোৎসবে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় জয়পুর রাজবাড়িতে
বছরের ৩৬১ দিনই মা দুর্গা থাকেন ব্যাঙ্কের লকারে। পুজোর চারদিন আগে মায়ের আগমন ঘটে কড়া পুলিশি পাহারায়। জেলা পুলিশের কড়া নিরাপত্তায় টানা চারদিন রাজ পরিবারে বিরাজমান হয়ে পুজো নেন দেবী।
রুপোর তৈরি চালচিত্রে সোনার দুর্গামুর্তি পূজিত হয় জয়পুর রাজবাড়িতে। তাই পুরুলিয়া জেলায় যে সমস্ত দুর্গা পুজো হয়ে থেকে তার মধ্যে জয়পুর রাজবাড়ীর দূর্গাপুজোর আকর্ষণ অন্যরকম। সোনার দুর্গা দেখতে গোটা জেলা তো বটেই, অন্য জেলার মানুষও ছুটে আসেন জয়পুর রাজবাড়িতে। কিন্তু এই বছর করোনা পরিস্থিতিতে দর্শনার্থীদের ভিড় এড়াতে সোনার দুর্গার আগমন ঘটবে না রাজবাড়িতে। ব্যাঙ্কের লকারেই থাকবে মায়ের মূর্তি ও চালচিত্র। তবে রাজবাড়িতে পুজো হবে প্রাচীন রীতিনীতি মেনেই।
রাজপরিবারের অন্যতম সদস্য শঙ্কর নারায়ণ সিংদেও জানান, প্রায় চারশো বছর আগে রাজা জয়সিংহ পুরুলিয়ার এই প্রান্তে পা রাখেন। তাঁর নামেই এই জায়গার নাম হয় জয়পুর। উজ্জ্বয়িনী থেকে এসে এই এলাকার মুন্ডা সর্দার খামার মুন্ডাকে হত্যা করে জঙ্গলমহলে এই জয়পুর এলাকার দখল নিয়েছিলেন তিনি। প্রাচীন কালে খামার মুন্ডা একটি খাঁড়াকে তাঁদের দেবী হিসেবে পুজো করতেন। রাজা জয় সিংহ এই খাঁড়াটিকে মুন্ডা বসতি থেকে ছিনিয়ে নিয়ে, শক্তির দেবী হিসেবে বিনা মূর্তিতেই এই খাঁড়াটিকে কলা বৌ হিসেবে পুজো করার রীতি প্রচলন করেন। কোনও লিখিত নথি নেই। কেবল চালু নানা গল্পকথা থেকেই এই তথ্য জানা যায়।
বহু বছর পর সপ্তম রাজা কাশীনাথ সিংহের আমলে দুর্গা পূজোর দিন অঘটন ঘটে যায়। আগুন লেগে যায় কলা বৌয়ের গায়ে। সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় গোটা ঘর। সেই সময় রাজা কাশীনাথ সিংহ মানত করেন সোনার প্রতিমা তৈরি করে তাতে রুপোর চালচিত্র লাগিয়ে মায়ের পুজো করবেন। এরপরই সোনার বিগ্রহ তৈরির জন্য বেনারসের স্বর্ণশিল্পীদের ডেকে পাঠিয়ে এক কেজি সোনার দ্বিভুজা দুর্গা মূর্তি ও দেড় মণ (৬০ কেজি) রুপোর চালচিত্র তৈরি করেন। সেই থেকে মহা ধূমধামের সঙ্গে সোনার বিগ্রহ পুজো হয়ে আসছে জয়পুর রাজবাড়িতে।
১৯৭০ সালে ঘটে যায় আরও এক বিপত্তি। সেই সময় একদল ডাকাত হানা দেয় এই রাজবাড়িতে। বহু খোঁজাখুঁজির পরেও সোনার মূর্তির হদিশ না পাওয়ায় ওই মন্দিরে থাকা সমস্ত অলঙ্কার ও অন্যান্য দামি সামগ্রী চুরি করে নিয়ে যায় ওই ডাকাত দলটি। এই ঘটনার পরই টনক নড়ে রাজপরিবার ও পুলিশের। তৎকালীন জেলা পুলিশ সুপারের উদ্যোগে রাজবাড়ীর দুর্গার স্বর্ণ বিগ্রহের নিরাপত্তা দিতে চালু হয় বিশেষ ব্যবস্থা। ঠিক হয় পূজোর পাঁচ দিন ছাড়া বাকি ৩৬১ দিন কড়া নিরাপত্তায় ব্যাঙ্কের লকারে থাকবে বিগ্রহ।
সেই থেকে আজও পর্যন্ত পূজোর চার দিনের জন্য ব্যাঙ্ক থেকে কড়া পুলিশি নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সোনার দুর্গা ও রুপোর চালচিত্র আনা হয় রাজবাড়িতে। প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় দেবীর। বিসর্জনের পরে দেবীমূর্তি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ব্যাঙ্কের লকারে।
এ বছর কোরোনা পরিস্থিতিতে রাজ পরিবারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ভিড় এড়াতে দেবীর সোনার মূর্তি ও চালচিত্র ব্যাঙ্কের লকারেই থাকবে। তবে পুজো হবে রীতিনীতি মেনেই।