নিকোনো দাওয়ায় অক্ষর বুনছেন ফুলমণি, অশিক্ষার অসুরকে যে বধ করতেই হবে
ভাঙা ঘরের বাইরে এক টুকরো নিকোনো দাওয়া। সেখানেই প্রতিদিন ভোরে বসে পাঠশালা। ছ’টা বাজতে না বাজতেই হৈ হৈ করে চলে আসে কচিকাঁচার দল। তাদের কলকাকলিতে গমগম করে ওঠে ফুলমণি কিস্কুর ঘরের বাইরেটা। শুরু হয়ে যায় আলোর উৎসব।
বর্ধমানের আউশগ্রামের জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত এলাকা যাদবগঞ্জের ঝাড়গড়িয়া। আদিবাসী অধ্যুষিত এই গ্রামে সময় যেন থমকে। বাইরের এগিয়ে যাওয়া পৃথিবী এখানে মুখ লুকোয়। এখানে বেঁচে থাকাটাই একটা মস্ত লড়াই। প্রতিদিনের রসদ জোগাড়ে কেটে যায় সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত। সেখানে পড়াশোনা শেখার সময় কোথায়? সেই চিন্তা করার অবকাশই যে হয় না কারও। তাই প্রজন্মের পর প্রজন্ম নিজেদের সরিয়ে রাখে শিক্ষার আঙিনা থেকে অনেক দূরে। তাই পাঠশালা খুলেছেন ফুলমণি।
কতই বা বয়স তাঁর? মেরেকেটে কুড়ি! পুরো নাম ফুলমনি কিস্কু। অনেক ছোটবেলায় বাবা মারা গেছে। তার পর থেকে বেশ কষ্ট করে ফুলমণি আর তাঁর দুই দাদাকে বড় করে তুলেছেন তাঁদের মা মাকালু কিস্কু। পরের জমিতে ঘাম ঝরিয়ে জোগাড় করেছেন তিন সন্তানের মুখের ভাত।
এখন বড় হয়েছেন সন্তানরা। ফুলমনির এক দাদা বাইরে থাকেন। কাজ করেন। আর এক দাদাও জনমজুরি খাটেন জমিতে। আর এসবের মধ্যেই প্রতিমুহূর্তে পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন ফুলমণি। জীবনের নানা ওঠাপড়ার কোনওটাই দমাতে পারেনি গুসকরা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের এই ছাত্রীকে। বাংলা আর সংস্কৃত নিয়ে পড়াশোনা করছেন ফুলমনি। মা আর দাদাদের রোজগারে অন্ন সংস্থান হলেও পড়াশোনার খরচ জোটে না। তাই যখনই পড়ার জন্য টাকাপয়সা দরকার হয়, মাঠের কাজে নেমে পড়েন। খেত মজুরের পারিশ্রমিকে সেই খরচ জোগাড় হয়ে গেলেই আবার পড়াশোনায় মন।
তাঁর স্বপ্ন, তিনি লেখাপড়া শিখে নার্স হবেন। চাকরি করবেন। বাড়ির মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই সহায় হবেন এলাকার মানুষেরও। তবে এই সমস্ত সম্ভাবনাই যে রয়েছে ভবিষ্যতের গর্ভে তাও বোঝেন। তাই সময় নষ্ট না করে এখনই নিজের মতো করে শুরু করে দিয়েছেন সমাজ গড়ার কাজ। তাঁর নজরে আসে এই অজ পাঁড়াগায়েও আজকাল অনেকেই পড়াশোনায় আগ্রহী। আগের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। কিন্তু তাঁদের বাবা মায়েরা শিক্ষার আলো থেকে অনেকটাই দূরে। তাই ইচ্ছে থাকলেও বাড়িতে ছেলেমেয়েদের পড়া দেখিয়ে দিতে পারেন না তাঁরা। টিউশন যে দেবেন সে সামর্থ্যও সকলের নেই। ফুলমণি এঁদের জন্যই খুলে বসেছেন বিনে পয়সার পাঠশালা। নিজের বাড়ির নিকোনো দাওয়ায়।
প্রতিদিন ভোরে ছ’টা বাজতে না বাজতেই হৈ হৈ করে ফুলমণির উঠোনে চলে আসে কচিকাঁচার দল। তাদের কাউকে অঙ্ক শেখান ফুলমণি। কাউকে পড়ান বাংলা। কেউ ইতিহাস বা ভূগোলের পাঠ নেয় ফুলমণির কাছে। তাদের পড়ানো, তাদের খুনসুটি সামলানো, সুবিধা অসুবিধা খেয়াল রাখার ঝক্কি কম নয়। তবুও নিজের পড়াশোনার বাইরের সময়টা এদের নিয়েই কাটাতে চান ফুলমণি। সকলকে জড়িয়ে বাঁচার আনন্দই যে আলাদা, এই আকালেও।
দেখুন ফুলমণির লড়াই।
ফুলমণির কথায়, ‘‘একমাত্র শিক্ষাই যে মানুষকে পথ চেনাতে পারে। তাই আমি চাই আমার গ্রামের সমস্ত ছোটরা পড়াশোনা শিখুক। আমি আমার সাধ্যমতো ওদের পাশে থাকার চেষ্টা করব।’’
ফুলমণির মা মাকালুর কথায়, ‘‘নিজের পড়ার খরচ জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হয় ওকে। জমিতে কাজ করে পড়ার খরচ জোগাড় করে। কিন্তু তাতেও হার মানে না। এই এত বাচ্চাকেও পড়াশোনা শিখিয়ে দাঁড় করাতে চায় ও।’’
বেজে উঠেছে ঢাক। আসছেন মা দুর্গা। দানবদলনী। অশিক্ষার অসুরকে বধ করে ফুলমনিও যেন জঙ্গলমহলের দুর্গা। তাকে নিয়ে তাই গর্বের শেষ নেই যাদবগঞ্জের আদিবাসী পাড়ার বাসিন্দাদের।
[…] ৬. বর্ধমানের আউশগ্রামের জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত এলাকা যাদবগঞ্জের ঝাড়গড়িয়া। আদিবাসী অধ্যুষিত এই গ্রামে সময় যেন থমকে। বাইরের এগিয়ে যাওয়া পৃথিবী এখানে মুখ লুকোয়। এখানে বেঁচে থাকাটাই একটা মস্ত লড়াই। প্রতিদিনের রসদ জোগাড়ে কেটে যায় সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত। সেখানে পড়াশোনা শেখার সময় কোথায়? সেই চিন্তা করার অবকাশই যে হয় না কারও। তাই প্রজন্মের পর প্রজন্ম নিজেদের সরিয়ে রাখে শিক্ষার আঙিনা থেকে অনেক দূরে। তাই পাঠশালা খুলেছেন ফুলমণি কিস্কু। […]