করোনার কাঁটা আর সামাজিক লাঞ্ছনা সামলে আজ নিজেই কোভিডযোদ্ধা অমৃতা
এক মুহূর্তে সাজানো গোছানো জীবনটা ওলোটপালোট হয়ে গিয়েছিল অমৃতা পাণ্ডার। কোভিডের কোপে যে এভাবে তাঁদের পরিবারকে পড়তে হবে তা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তিনি। তাই ঝড়টা জীবনে আসার পরে প্রথমে অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক গ্রাস করেছিল গোটা পরিবারকে। কিন্তু লড়াই ছাড়েননি অমৃতা। আতঙ্ক কাটিয়ে উঠে হয়েছেন কোভিড যোদ্ধা। অন্য আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি, দান করেছেন প্লাজমা। আর এভাবেই অমৃতা হয়ে উঠেছেন আজকের শক্তি, আজকের দুর্গা।
করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরে অমৃতা পাণ্ডার পরিবারের আট সদস্যের মধ্যে ছ’জনই আক্রান্ত হন করোনাভাইরাসে। অমৃতার কথায়, “মে মাসের ১ তারিখে আমাদের পরিবারের সবার জ্বর আসে। দাদুর বয়স ৮২ বছর। দিদিমার বয়স ৭৫ বছর। আমার বাবা, দাদু, দিদিমা, দিদি, জামাইবাবু সবার জ্বর আসায় ডাক্তার বলেন কোভিড টেস্ট করাতে। প্রথমে আমরা সবাই হেসেছিলাম। তার পরেই কোভিড টেস্ট করানো হয়। তাতে আমার দাদু, আমার, মায়ের ও জামাইবাবুর রিপোর্ট পজিটিভ আসে। দিদির ও বাবার রিপোর্ট ছিল অসম্পূর্ণ। যদিও তাদের উপসর্গ ছিল। আর আমার বোনপো ও দিদার রিপোর্ট নেগেটিভ আসে।”
আক্রান্ত হওয়ার পরে হোম আইসোলেশনে থেকে শুরু হয় তাঁদের নতুন লড়াই। অবশ্য এই সময়ে নানা রকমের অভিজ্ঞতা হয়েছে অমৃতার। সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটা ছড়িয়ে পড়ার পরে অনেক রকমের প্রতিক্রিয়া দেখেছেন তিনি। কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কেউ আবার দূরে সরে গেছেন।
অমৃতা জানিয়েছেন, “আমরা খুব ভাগ্যবান যে এমন এক প্রতিবেশী পেয়েছি যাঁরা প্রতিদিন আমাদের খাবার দিয়েছেন। খোঁজ-খবর নিয়েছেন। বলেছেন পাশে আছি, লড়াই কর। আবার অন্য অভিজ্ঞতাও হয়েছে। আতঙ্কিত হয়ে অনেকেই বলেছেন কোভিড আক্রান্ত হওয়ায় বাড়ির জানলা বন্ধ রাখতে। কিন্তু আমরা সেটা চাইনি। তখন আমরা পুলিশের সাহায্য নিই। এই ক্ষেত্রে পুলিশ আমাদের অনেক সাহায্য করেছেন।”
দেখুন অমৃতার কাহিনি।
হোম আইসোলেশনে থাকাকালীন অনেক গুজবের মোকাবিলাও করতে হয়েছে অমৃতাদের। কখনও গুজব ছড়িয়েছে তাঁর বাবা মারা গিয়েছেন। তাতে আঘাত পেলেও ভেঙে পড়েননি তাঁরা। ১৭ দিন হোম আইসোলেশনে থাকার পরে সুস্থ হয়ে ওঠেন পরিবারের সবাই। হাসপাতাল থেকে ফিরে আসেন তাঁর ৮২ বছর বয়সী দাদুও। কিন্তু তারপরেও রাস্তাঘাটে অনেক সময় কটাক্ষ শুনতে হয়েছে অমৃতা কিংবা তাঁর বাবাকে। ব্যাঙ্কে পর্যন্ত ঢুকতে দেওয়া হয়নি অমৃতার বাবাকে। পরে প্রশাসনের সাহায্য পান তাঁরা।
আর ঠিক সেই সময়েই জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন অমৃতা। তিনি ঠিক করেন প্লাজমা দান করবেন। পশ্চিমবঙ্গের দশম প্লাজমা ডোনার তিনি। প্লাজমা দান করেছেন তাঁর জামাইবাবুও। শুধু তাই নয়, কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন অমৃতা। কোভিড জয়ী মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন ‘কোভিড কেয়ার নেটওয়ার্কে’ যোগ দিয়েছেন তিনি। সাহায্য করছেন অন্য করোনা আক্রান্তদের পাশে দাঁড়াতে। তাঁদের যতটা সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করছেন।
অমৃতার এই কাজে মুগ্ধ তাঁর বাবা থেকে শুরু করে প্রতিবেশীরাও। যেভাবে তিনি সবাইকে সচেতন করার কাজ করে চলেছেন তাতে সবাই তাঁর পাশে রয়েছেন। শুধু নিজেরাই কোভিডের মোকাবিলা করে সুস্থ হয়ে উঠেছেন তাই নয়, একজন সচেতন মানুষ হিসেবে নিজের কাজকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন তিনি। অসুস্থ, বিষাদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত। আর তাই এই করোনার কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়েও অমৃতা পাণ্ডা বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনিই শক্তি, তিনিই দুর্গা।